বারোমাসের অমাবস্যা ব্রত

বারোমাসের অমাবস্যা ব্রত

প্রতিমাসের অমাবস্যাতে বারোমাসের অমাবস্যা ব্রত পালন করা হয়। এই ব্রতে সূর্যদেবকে পূজা করা হয়। জেনে নেওয়া যাক এই ব্রতের পেছনে প্রচলিত কাহিনী।

এক দেশে এক বামুন বামুনি তার ছেলেকে নিয়ে বাস করতেন। তাঁরা খুব গরিব ছিলেন। তাঁদের ছেলের যখন ষোলো বছর বয়স তখন তাঁরা তাঁর বিয়ে দিলেন। তাঁদের ছেলের নাম তপন। কারও কারও মতে তাঁর নাম সূর্য। বিয়ের কিছুদিন পর ছেলেটি হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। বামুন বামুনি এবং তাঁদের বৌমা সবাই কেঁদে কেঁদে পাগল হয়ে যাওয়ার দশা হল। এইরকম অবস্থায় ছেলের শোকে বামুন হঠাৎ মারা গেলেন। তখন বামুনি আর তাঁর বৌমা দুজনে অতি কষ্টে দিন কাটাতে লাগলেন। এই ভাবে তাঁদের বারো বছর কেটে গেল।

হঠাৎ তাঁদের বাড়িতে একদিন এক অতিথি এসে হাজির হলেন। তিনি বামুনির কাছে খাবার দিতে বলে পুকুরে স্নান করতে গেলেন। স্নান করে এসে তিনি বললেন, “তোর ছেলের ধুতি দে পড়ি!” তারপর একসময় বললেন “তোমার ছেলের খড়ম জোড়া দাও, পড়ি”, তো কখনও বললেন, “তোমার ছেলের থালায় ভাত দাও!” আবার কখনও “তোমার ছেলের গ্লাসে জল দাও, খাই” এইসব বলতে থাকেন। বামুনি সব আনন্দ করেই দেয়। মনে মনে ভাবেন “এগুলো তো পড়েই আছে এ না হয় খাক, আমাদের ভালো লাগবে।” কিন্তু স্বামীর জিনিস অন্য লোকে ব্যবহার করছে দেখে বামুনির বৌমা রাগে গজ গজ করেন। বামুনি তার বৌমাকে বুঝিয়ে বলেন যে অতিথি নারায়ণ ওই রকম করতে নেই অমঙ্গল হয়।

সেই অতিথির খাওয়া হয়ে গেলে বামুনিকে বললেন, “তোমার ছেলের ঘর খুলে দাও! আমি শোব”বামুনি তাই করলেন। তারপর তিনি বললেন, “তোমার বৌমাকে পাঠিয়ে দাও, আমার গা হাত পা টিপে দেবে।”এই কথা শুনে তো বউমা রেগে গেলেন এবং শাশুড়িকে জানালেন তিনি কিছুতেই অচেনা লোকের কাছে যাবেন না, কিন্তু শেষে শাশুড়ি অনেক বোঝাতে তিনি হাত পা টিপতে রাজি হলেন। যখন বউমা সেই অতিথির কাছে এলেন, তখন দরজা বন্ধ করে সেই অতিথি বললেন, “ভয় নেই! আমিই তোমার স্বামী। আমার নাম তপন। আমাকে চিনতে পারছো না?” বউমা তখন আনন্দে তার স্বামীর গা হাত পা টিপে দিল। তারপর তপন বিশ্রাম নিয়ে বিকালে ঘুম থেকে উঠে আবার চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, “আমি যে তোমার স্বামী এই কথা মাকে এখন বলো না।”

এইরকম করে তপন অতিথি হয়ে মাঝেমধ্যে আসে, খায়, বিশ্রাম নেয়, আবার চলে যায়।এই ভাবে আসা যাওয়ায় বামুনি আর সেই অতিথির মধ্যে মা -ছেলের সম্বন্ধ গড়ে ওঠে।বামুনি একদিন সেই অতিথিকে বলে, “আমাদের এমন কষ্ট কি করে কম হবে তা বলতে পারো বাবা?” তপন বলেন, “তুমি বারোমাসের অমাবস্যা ব্রত কর তাহলে কষ্ট দূর হবে।” শুনে বামুনি বললেন, “আমি তো বারোমাসের অমাবস্যা ব্রত করি। কিন্তু আমার যা কষ্ট তাই আছে দূর হলো কই?”শুনে অতিথি বললেন, “আরো কিছুসময় করো তাহলে দূর হবে।”একদিন অতিথি এসে বলেন, “মা তোমার আঁচলটা দাও দেখি।” এই বলে আঁচলে কতগুলো বড় বড় সাদা মুক্ত দিয়ে বললেন, “এতে তোমার দুঃখ ঘুচবে।”

বামুনি ভাবলেন ওইগুলো খাবার জিনিস, তাই সেগুলো বৌমাকে সিদ্ধ করতে দিলেন। এক প্রহর কেটে গেল কিন্তু সেগুলো সিদ্ধ আর হয় না। এরপর বউমাকে সেগুলো ভাজতে বললেন কিন্তু ভাজাও গেল না। তারপর সেগুলো ঢেঁকিতে পিষলেন, তাতেও ওগুলোর কিছু করা গেল না। শেষে তারা মুক্ত গুলোকে আস্তকুঁড়ে ফেলে দিলেন। আবার কিছুদিন বাদে তপন এলেন, এসে মায়ের এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যে জিনিসগুলো দিয়েছিলাম সেগুলো কি হলো?”বামুনি বললেন, “ও বাবা সিদ্ধ করে, ভেজে, কুটে কিছুতেই খাওয়া গেল না, তাই সেগুলো ফেলে দিয়েছি।”তপন তখন তাঁর মা, বউকে সেখানে নিয়ে গিয়ে দেখে সেখানে মুক্ত গাছ হয়েছে আর তাতে অনেক মুক্ত হয়েছে। তিনি বললেন, “এই গুলো মুক্ত, এইগুলো বেচে তোমাদের অনেক পয়সা হবে। রাজার হালে দিন কাটবে।” এই বলে তিনি চলে গেলেন। বামুনি মুক্তগুলো বেঁচে বাড়ি, পুকুর মন্দির সব করলেন। তাঁর অনেক দাসদাসী হল।

এরপরে আবার একদিন তপন এলেন। তখন বামুনি কেঁদে কেঁদে বললেন, “আর আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না। তোমায় দেখতে না পেলে বৌমা মনমরা হয়ে থাকে,তুমি আমার ছেলে হয়ে আমার কাছে থাকো।”তখন তপন তাঁর হাতের আংটি দেখিয়ে বললেন, “মা এটাকে চিনতে পারছো?”বামুনি কাদঁতে কাদঁতে বললেন, “এটা তো আমার ছেলের বিয়ের আংটি।”তপন বললেন, “আমিই তোমার তপন। তুমি আমায় চিনতে পারোনি।”তোমার বারোমাসের অমাবস্যার ব্রতের ফলেই আমি আবার তোমার কাছে ফিরে এসেছি।তা শুনে তার বউমা মুচকি হাসছে দেখে বামুনি বললেন, “ও হরি! তুমি সব জানতে বৌমা?তাহলে আমায় বলোনি কেন?”তাঁর বৌমা বললেন, “উনি যে আমায় মানা করেছিলেন।” এরপর বামুনি তাঁর ছেলে বৌমাকে নিয়ে সুখে সংসার করতে লাগলেন। এইভাবে বারোমাসের অমাবস্যা ব্রত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।