সন্তোষী মা হিন্দু ধর্মের একজন অন্যতম দেবী।সন্তোষী মাতাকে সন্তোসের অধীস্টানী দেবী বলে অভীহিত করা হয়।বিশেষ করে উত্তর ভারত ও নেপালের মহিলারা সন্তোষী মায়ের পুজা করে থাকেন।বার্ষিক ১৬ টা শুক্রবার সন্তোষী মায়ের ব্রত পালন করলে দেবী সন্তুষ্ট হন বলে মান্য করা হয়। দেবীর জন্ম শুক্রবার পুর্নিমা তিথিতে হয়।তাই সন্তোষী মায়ের পুজার জন্য শুক্রবার দিনটি শ্রেষ্ঠ।
ইনি চতুর্ভুজা তথা রক্ত বস্র পরিহিতা, হাতের দুটিতে ত্রিশূল ও তলোয়ার ধারন করেন ও বাকি দুটি হাতে বরাভয় ও সংহার মুদ্রা ধারন করেন।সন্তোষী মায়ের ত্রিশূল পাত তিনটি গুনের (সত্য,রজ ও তম)প্রতিক ও তলোয়ারটি গ্যানের প্রতিক। আসুন জেনে নিন শুক্রবার সন্তোষী মায়ের ব্রত পালনের নিয়ম৷ ব্রত পালনের নিয়মঃ- প্রতি শুক্রবারে উপবাস করে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র, ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে সন্তোষী মাতার ব্রত পাঠ করতে হবে। অপর কোন তিথি বা নক্ষত্রজনিত নিষেধ নেই।
ব্রতের ফলঃ- মা সন্তোষী — মা সন্তোষীর পূজাতে টক বস্তু, আমিষ দ্রব্য প্রদান নিষেধ । সাধারণত আমিষ দ্রব্যকে তমঃ গুন সম্পন্ন আহার বলা হয় । টক পদার্থ হল রজগুনী আহার । মিষ্ট দ্রব্য হল সত্ত্ব গুনী আহার । মায়ের ভক্তদের ঐ তম, রজ গুনের ওপরে সত্ত্ব গুনে অধিষ্ঠিত হতে হয় । তাই ভক্ত গন মাকে কেবল মিষ্ট দ্রব্য ভোগে অর্পণ করেন। মায়ের প্রসাদ গো জাতীয় প্রানীকে অল্প প্রদান করার নিয়ম। কারন গো মাতা হিন্দু দিগের আরাধ্য।
গো জাতিকে রক্ষা ও ভরন পোষণের জন্য এই নিয়ম ।প্রতি শুক্রবারে মায়ের ব্রত করার নিয়ম। মায়ের পূজোতে সরিষার তৈল নিষেধ। ঘিয়ের প্রদীপ দিতে হয়। সরষের তেল রজ গুনী। তাইএকাদশী তিথিতে সরিষার তৈল বর্জনীয়। শুক্রবারে স্নান সেড়ে শুদ্ধ বস্ত্রে মায়ের পূজো করতে হবে। তিথি নক্ষত্র দোষ নেই এই পূজাতে। সাধারণত উদযাপন ছাড়া এই পূজোতে পুরোহিত লাগে না।
সবাই করতে পারবেন । খেয়াল রাখবেন এই দিন গৃহে কোন সদস্য বা যিনি ব্রত পূজা করবেন- ভুলেও যেনো টক পদার্থ না গ্রহণ করেন। অনান্য সদস্য গন হোটেলে বা রেষ্টুডেন্ট, বিয়ে , অন্নপ্রাশনে খাবেন না। ঘট স্থাপন করবেন বট, কাঠাল, পাকুড় পল্লব দ্বারা। আম পল্লব দেবেন না । পূজোতে সব পুষ্পই চলবে। বিল্বপত্র আবশ্যক । ঘটে পুত্তলিকা অঙ্কন করবেন সিঁদুরে ঘি মিশিয়ে। ঘি প্রদীপ পূজাতে ব্যবহার করবেন ।
ঘটে গোটা ফল হিসাবে কলা দেবেন । এরপর আচমন , বিষ্ণু স্মরণ, আসন শুদ্ধি, সূর্য অর্ঘ, সঙ্কল্প করে গুরুদেব ও পঞ্চ দেবতার পূজা করে মায়ের পূজা করবেন । ধ্যান মন্ত্র প্রনাম মন্ত্র বলবেন । মনের প্রার্থনা মায়ের চরণে জানাবেন। পূজা শেষে মায়ের প্রসাদ গোমাতা কে অল্প দিয়ে নিজে গ্রহণ করবেন । এই ভাবে ১৬ শুক্রবার ব্রত করবেন । ভোগে দেবেন ভেজানো ছোলা ও আঁখের গুড়। ইচ্ছা হলে মিষ্ট ফল নিবেদন করতে পারেন । শুক্রবার যিনি ব্রত করবেন সারা দিন উপবাস থাকবেন ।
দুধ, ছোলা ঘিতে আলু সহিত ভেজে, মিষ্ট ফল, জল গ্রহণ করবেন । অসমর্থ হলে একবেলা উপবাস রেখে অপর বেলা আলু সেদ্ধ, ঘি, আতপ অন্ন গ্রহণ করতে পারেন । ১৬ শুক্রবার ব্রত হলে উদযাপন করবেন । উদযাপনের দিন ৭ টি বালককে ভোজোন করাবেন । খেয়াল রাখবেন সাত বালক যেনো সেই দিন টক বস্তু না খায় । উদযাপনের দিন ১৬ টি নিমকী চিনির রসে ডুবিয়ে মায়ের কাছে উৎসর্গ করবেন। ছানা থেকে তৈরী কোন মিষ্টি মাকে দেবেন না। উদযাপনের দিন মায়ের কাছে একটি নারকেল ফাটিয়ে নারকেলের জল মায়ের চরণে দেবেন ।
নারকেল মায়ের সামনে ফাটাবেন এক আঘাতে। ফাটানোর সময় মায়ের নামে জয়ধ্বনি দেবেন । এই ভাবে মা সন্তোষীর ব্রত করুন। দেখবেন মায়ের কৃপায় আপনার জীবন সুখে শান্তিতে ভরে যাবে । মায়ের কৃপায় সব অমঙ্গল, দুঃখ, অশান্তি নষ্ট হবে । ভক্তিভরে যে নারী এই ব্রত উদ্যাপন করবে- তার সব কামনা সিদ্ধ হবে। গৃহে অর্থাভাব থাকবে না। পুজোর জন্য লাগবে সন্তোষী মায়ের ছবি ব্রতকথার বই ঘট, পানপাতা,ফুল,কর্পূর,ধূপকাঠি, প্রদীপ‚ ঘি বা তেলে পূর্ণ,হলুদ,সিঁদুর, ঘটে রাখার জন্য ফল‚ মূলত নারকোল বা কলা,হলুদ মেশানো আতপ চাল ছোলা‚ গুড় আর কলা হল প্রসাদ পুজো পদ্ধতি ঘরের এক কোণ পরিষ্কার করে কাঠের আসন পাতুন |
প্রতিষ্ঠা করুন দেবী ছবি | নইলে রোজ যেখানে পুজো করেন‚ সেখানেও করা যায়। শুক্রবার সকালে স্নান সেরে পরিষ্কার বসনে দেবীর সামনে ঘট প্রতিষ্ঠা করুন | ঘটে গঙ্গাজল ‚ বা গঙ্গাজল না পেলে এমনি পরিষ্কার জল দিয়ে পূর্ণ করুন | ঘটের উপর ফল রাখুন | প্রসাদ হিসেবে দিন ধান, দুর্বা, ফুল, ছোলা, গুড় বা বাতাসা | প্রথমে সন্তোষী মায়ের বাবা গণেশ এবং দুই মা ঋদ্ধি ও সিদ্ধির পুজো করুন | তারপর সন্তোষী দেবীর ব্রতকথা পাঠ করুন |পাঠ শেষে শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিন | প্রণাম করে বলুন‚ ‘ জয় সন্তোষী মা !’ এরপর আরতি করুন |
শান্তির জল ছিটিয়ে দিন বাড়ির সর্বত্র | প্রসাদ বিতরণ করে ওই প্রসাদ দিয়েই ভঙ্গ করতে পারেন উপবাস | বা সারাদিনও রাখতে পারেন উপবাস | শুক্রবার সন্তোষী মায়ের আবির্ভাবের দিন বলে ওইদিন এই পুজো পালিত হয় | কোনও তিথি নক্ষত্রের বিধিনিষেধ নেই | যেকোনও বয়সী নারীপুরুষ এই ব্রত পালন করতে পারেন | ব্রতপালনের একটাই মূল শর্ত হল‚ যিনি পালন করবেন‚ সেই ব্রতী এদিন টকজাতীয় কিচ্ছু খেতে পারবেন না | প্রসাদেও টক খাবার যেন কিছু না থাকে | ষোল সপ্তাহ বা চারমাস পরে উদযাপন করতে হয় ব্রত |
ওইদিন একইভাবে পুজো করার পরে আটজন বালককে ডেকে ভোজন করাতে হয় | নিজের পরিবারে না থাকলে পরিচিতদের থেকে নিমন্ত্রণ জানানো যায় বালকদের | ভোজনের পরে তাদের বস্ত্র‚ ফল এবং দক্ষিণা দিতে পারেন | মাতা সন্তোষী দেবীর প্রনাম মন্ত্র, ওঁ শ্রী সন্তোষী মহামায়ে, গজানন্দময় দায়িনী। শুক্রবার প্রিয়ে দেবী, নারায়ণী নমহস্তুতে।।। জয় সন্তোষী মা। ত্রিনয়ন হল চন্দ্র, সূর্য, অগ্নির প্রতীক। দেবী হলেন জ্ঞানদায়িনী। তিনি অবিদ্যা, ভ্রমতা দূর করেন, তথা ভক্তকে চতুর্বিধ ফল ও মহামুক্তি প্রদান করেন। আমরা জানি ত্রিকালের কথা। অতীত কাল, বর্তমান কাল, ভবিষ্যৎ কাল।
মা ত্রিনয়নী। তিনি অতীত কাল জানেন, বর্তমান কালে কি হচ্ছে- তাও তিনি জানেন, আগামীতে কি হবে- তাও তিনি জানেন। তাই মা ত্রিনয়নী। মা সন্তোষী রত্ন সিংহাসনে বিরাজিতা। কারন তিনি সকল প্রকার ঐশ্বর্যের অধীশ্বরী । তিনি নানান রত্ন অলঙ্কার ধারন করে আছেন। তিনি ঐশ্বর্যময়ী । রত্ন অলঙ্কার কে আমরা লক্ষ্মীর স্বরূপ শুভ বলে মানি। মায়ের আশিষে সকল প্রকার অশুভ জড়তা খন্ডিত হয়ে শুভ শক্তির স্থাপনা ও বিরাজমানা হয়, তাই মায়ের শরীরে অলঙ্কার । মা সন্তোষীর চার বাহু।
চারদিকে সর্বত্রই মায়ের নিয়ন্ত্রন । মায়ের হাতে তরবারি থাকে। তরবারি তীক্ষ্ণ ধার । তীক্ষ্ণ বা ক্ষিপ্র গতিবেগ বা বুদ্ধির পরিচয় । মায়ের অপর হাতে থাকে ত্রিশূল। ত্রিশূল ত্রিগুনের সমাহার । ত্রিশূলের তিনটি ফলা যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের প্রতীক । সত্ত্ব, রজ, তম এই ত্রিগুনের সমাহার হল ত্রিশূল। এই ত্রিশূল থাকে মায়ের হাতে। তিনি সত্ত্ব, রজ, তম ত্রিগুনের সমাহারেই বিশ্ব চালিত করছেন। ত্রিশূল হল শিবকোষ বা অনন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডারের চাবি। এই ব্রহ্মজ্ঞানের চাবিটি মা নিজের হস্তে ধারন করেন।
অর্থাৎ মা যেমন সকাম উপাসক দের চতুর্বিধ ফল দান করেন, আবার যোগীদের ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন । আবার ত্রিশূল অশুভ শক্তির নাশ করে। মা দুর্গার পদতলে আমরা ত্রিশূল বিদ্ধ মহিষাসুরকে দেখতে পাই । ভগবান শিব এই ত্রিশূলেই ত্রিপুর অসুরকে বধ করেছেন। ত্রিশূল আসুরিক শক্তির বিনাশ ঘটায়। দৈবশক্তির সূচনা করে । তাই ত্রিশূলকে পবিত্র মনে করে পূজা করা হয় । তাই মা শুভশক্তির প্রতীক , আসুরিক শক্তি ভাব বিনষ্টের প্রতীক ত্রিশূল ধারন করেন। মা নিজেই আসুরিক ভাব নষ্ট করে দৈবভাব স্থাপনা করেন ।
মা সন্তোষী নামের অপর একটি ব্রতকথা শোনা যায় । সেটি হল বিজু ও মালিনীর উপাখ্যান। মালিনীর ঘটনা ঐ একরকম। বিজু কোন কারনে কাজ করতে শহরে চলে যায় । সেখানে গিয়ে এক নারীর প্রেমে পড়ে বাড়ীর কথা স্ত্রীর কথা ভুলে যায় । অপরদিকে শ্বশুর বাড়ীতে মালিনীর ওপর অত্যাচার বৃদ্ধি হলে, মালিনী ভাবে সে আত্মহত্যা করে মুক্তি পাবে। এই ভেবে মালিনী পাহাড়ের ওপর থেকে খাদে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হয়। ঠিক সেই সময় দেবর্ষি নারদ মুনি প্রকট হয়ে বললেন- ‘আত্মহত্যা মহাপাপ।
তুমি গৃহে ফিরে ষোলো শুক্রবার সন্তোষী মায়ের ব্রত করো।’ নারদ মুনি মালিনীকে ব্রতের সমস্ত নিয়ম শিখিয়ে দেয় । গৃহে ফিরে মালিনী সন্তোষী মায়ের ১৬ শুক্রবার ব্রত পালন করতে থাকে। অল্প কালের মধ্যেই মা সন্তোষী ভক্তের প্রতি সন্তুষ্ট হন। বিজুর পূর্ব স্মৃতি ফিরে আসে। সে অনেক জিনিস পত্র নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে। এরপর মালিনীকে নিয়ে সুখে থাকতে লাগে । মা সন্তোষীর বাহন বৃষ। কেন? গো জাতি সত্ত্ব গুনী সাত্ত্বিক গুনের আধার। বৃষর মধ্যে আমরা দুটি গুন দেখতে পাই।
বৃষ যখন শান্ত তখন সে চলনে মন্থর , সদা তৃপ্ত, প্রসন্ন । কিন্তু ক্রোধ হলে সে ঠিক উল্টো । শিং, খুঁড় দিয়ে আঘাত এমনকি হত্যা করতে পারে। কিন্তু বৃষকে আমরা সব সময় শান্তভাবে মা সন্তোষীর পদতলে দেখতে পাই। মানুষের মধ্যেও ক্রোধ ও শান্ত- দুই ভাব বিরাজ করে। ক্রোধে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়, আবার শান্ত ভাবে প্রসন্ন , হাস্যমুখর । কিন্তু যখন ভগবানের কাছে যেতে হবে, তখন প্রসন্ন চিত্তে , শান্ত অবস্থায় যেতে হবে। ক্রোধ নিয়ে ভগবানের কাছে গেলে কিছুই প্রাপ্তি হবে না । বৃষ আমাদের সেই শিক্ষাই দেয় ।