হিন্দু ধর্ম অনুসারে জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণের আবির্ভাব দিবস পালনের কয়েক দিন পরেই এবার শ্রীরাধিকার জন্মদিবস। প্রপঞ্চ লীলায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা স্বরূপশক্তি গোলোকেশ্বরী রাধারাণী ভাদ্র মাসে শুক্লা অষ্টমী তিথিতে অনুরাধা নক্ষত্রে সোমবারে মধ্যাহ্ন কালে ব্রজমণ্ডলে শ্রীগোকুলের অনতিদূরে রাভেল নামক গ্রামে শ্রীবৃষভানু রাজা ও কীর্তিদা মায়ের ভবনে সকলের হৃদয়ে আনন্দ দান করে আবির্ভূত হন। শ্রী রাধারাণী প্রাননাথ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যাথীত এই রাধাষ্টমী তিথীর সম্যক মাহাত্ম্য কেউই বনর্ণা করতে পারেনা।সনাতন ধর্মানুসারীরা এই দিনটিকে রাধাষ্টমী হিসেবে পালন করেন। কথিত আছে, একসময় সূর্যদেব পৃথিবী ভ্রমণ করতে আসেন। সেই সময় পৃথিবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি মন্দর পর্বতের গুহায় গভীর তপস্যায় মগ্ন হন।
সূর্যদেব দিনের পর দিন তপস্যায় রত থাকায় পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। স্বর্গের দেবতারা তখন সৃষ্টি রক্ষার জন্য শ্রীহরির শরণাপন্ন হন। তখন স্বর্গের দেবতারা ভীত হয়ে শ্রীহরির কাছে সাহায্যের জন্য যান। শ্রীহরি সূর্যের সামনে উপস্থিত হলে সূর্যদেব খুব আনন্দিত হন। সূর্যদেব বলেন আপনার দর্শন পেয়ে আমার তপস্যা সার্থক হলো। শ্রীহরি তাকে বর দিতে চাইলে, সূর্যদেব বলেন আমাকে এমন একটি গুণবতী কন্যার বর প্রদান করুন যার কাছে আপনি চিরকাল বশীভূত থাকবেন। শ্রীহরি তথাস্ত বলে তাই বর দিয়েছিলেন। শ্রীহরি বলেছিলেন পৃথিবীর ভার লাঘবের জন্য আমি বৃন্দাবনের নন্দালয়ে জন্মগ্রহণ করব।
তুমি সেখানে বৃষভানু রাজা হয়ে জন্মাবে। শ্রীমতি রাধা তোমার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করবে। এই ত্রিলোকে আমি একমাত্র শ্রী রাধিকারই বশীভূত থাকবো। রাধা ও আমার মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকবে না। আমি সবাইকে আকর্ষণ করি কিন্তু একমাত্র রাধিকাই আমাকে আকর্ষণ করবে। এরপর শ্রীহরি নন্দালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সূর্যদেব বৈশ্যকুলে জন্মগ্রহণ করে বৃষভানু রাজা হলেন এবং গোপকন্যা কীর্তিদার সঙ্গে তার বিবাহ হল। তারপর যথাকালে ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষে অষ্টমী তিথিতে ধরিত্রীকে পবিত্র করে কীর্তিদার গর্ভে শ্রীমতি রাধারানী জন্মগ্রহণ করেন।
এই রাধারানীর আবির্ভাব তিথিই রাধাষ্টমী নামে পরিচিত। অন্য এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, সেকালে যমুনা নদী বর্ষাণার রাভেল স্থানটির পাশ দিয়ে বয়ে যেত। একদিন রাজা বৃষভানু নদীতে স্নান করতে গিয়ে দেখলেন, হাজার সূর্যের আলোর ন্যায় জ্যোতির্ময় এক সোনার পদ্ম ঠিক যমুনা নদীর মাঝখানে ফুটে আছে, যার মধ্যে রয়েছে একটি ছোট শিশুকন্যা। তারপর ভগবান ব্রহ্মা এসে বিস্মিত রাজাকে জানালেন যে রাজা বৃষভানু ও তাঁর পত্নী কীর্তিদা পূর্বজন্মে ভগবান বিষ্ণুর পত্নীকে কন্যারূপে লাভ করার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন।
তার ফলস্বরূপই এই জন্মে রাজা স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর পত্নীকে কন্যারূপে পেয়েছেন। এরপর রাজা বৃষভানু সেই শিশুকন্যাকে নিয়ে এসে তার পত্নী কীর্তিদার হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু তারা দেখলেন শিশুটি কিছুতেই চোখ খুলছে না। তারা ভাবলেন শিশুটি বোধহয় অন্ধ! তখন নারদমুনি রাজা বৃষভানুর কাছে এসে রাজাকে শিশুটির জন্মের জন্য আনন্দের উৎসব করতে বললেন। নারদমুনীর কথা অনুযায়ী রাজা বৃষভানু উৎসবের আয়োজন করলেন। সেই উৎসবে নন্দ মহারাজ শিশু কৃষ্ণসহ সপরিবারে এসেছিলেন।
ঐ অনুষ্ঠানে শিশু কৃষ্ণ যখন হামাগুড়ি দিয়ে শিশু রাধারাণীর দিকে এগিয়ে এলেন, সেই মুহুর্তে রাধারাণী চোখ খুলে প্রথমে দেখলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে। বৃন্দাবনের নিকটবর্তী বর্ষাণা এলাকার অন্তর্গত পবিত্র রাভেল নামক জায়গায় রাধারাণী আবির্ভূত হয়েছিলেন। রাধাষ্টমী ব্রত পালন প্রসঙ্গে ভগবত ও পুরাণে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি একবারের জন্যও এই ব্রত পালন করেন তার কোটি জন্মের ব্রহ্ম হত্যার মত মহাপাপ বিনষ্ট হয়। শত শত একাদশী ব্রত পালনে যে ফল লাভ হয় রাধাষ্টমী ব্রত পালন করলে তার শতাধিক ফল লাভ হয়ে থাকে।
পুরাকালে লীলাবতী নামে এক পতিতা বাস করতো। নগর ঘুরতে এসে সে দেখে সুসজ্জিত এক মন্দিরে মহাধুমধাম করে রাধা রানীর পূজা করা হচ্ছিল। সে এগিয়ে গিয়ে ব্রতীদের জিজ্ঞাসা করে সেখানে কিসের উৎসব পালিত হচ্ছে। ব্রতীরা রাধা মহারানীর আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে রাধাষ্টমী ব্রত পালনের কথা ও তার মহাফল সব সবিস্তারে তাকে বলে। সেই পতিতারও এই ব্রত পালনের ইচ্ছে হয়, সেও অন্য ব্রতীদের সাথে রাধাষ্টমী পালন করে। পরদিন সর্প দংশনে তার মৃত্যু হয়। যমদূতেরা ওই পতিতাকে নিয়ে যমলোকে যাত্ৰা করলে সেখানে শ্রী হরির লোকেরা উপস্থিত হয়ে তাকে বন্ধন মুক্ত করে বৈকুণ্ঠ লোকে নিয়ে যায়। এই ভাবে ওই লীলাবতী নামে পতিতা নারীও রাধাষ্টমী ব্রত পালন করে সর্বপাপ মুক্ত হয়েছিলেন।
পদ্মপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড ৭/৮) বলা হয়েছে –
একাদশ্যাঃ সহস্রেন যং ফলং লভতে নরঃ। রাধা জন্মাষ্টমী পুণ্যং তস্মাং শত গুণাধিকম্।। “একহাজার একাদশী ব্রত পালন করলে যে ফল লাভ হয়, শ্রীরাধাষ্টমী ব্রত পালন করলে তার চেয়ে শতগুন অধিক ফল লাভ হয়ে থাকে।” আরও বলা হয়েছে, ” কোটি জন্মের অর্জিত পাপরাশি ভক্তিপূর্ণ রাধাষ্টমী ব্রত ফলে বিনষ্ট হয়। সুমেরু পর্বত প্রমান সোনা দান করলে যে ফল লাভ হয় একটি মাত্র রাধাষ্টমী ব্রত উদ্যাপন করে তার শতগুন অধিক ফল লাভ হয়। গঙ্গা ইত্যাদি সমস্ত পবিত্র তীর্থে স্নান করে যে ফল লাভ হয় একমাত্র বৃষভানুকন্যার জন্মাষ্টমী পালন করে সেই ফল লাভ হয়।
পদ্মপুরাণে আরো বলা হয়েছে –
রাধাষ্টমী ব্রতং তাত যো ন কুর্য্যাচ্চ মূঢ়ধী। নরকান্ নিষ্কৃতি নাস্তি কোটিকল্পশতৈরপি।। “যে মূঢ় মানুষ রাধাষ্টমী ব্রত করে না, সে শতকোটি কল্পেও নরক থেকে নিস্তার পেতে পারেনা।” স্ত্রীয়শ্চ যা না কৃবন্তি ব্রতমেতদ্ সুভপ্রদম। রাধাকৃষ্ণপ্রীতিকরং সর্বপাপপ্রনাশম্।। অন্তে যমপুরীং গত্বা পতন্তি নরকে চিরম্। কদাচিদ্ জন্মচাসাদা পৃথিব্যাং বিধবা ধ্রুবম্।। “যে নারী শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের প্রীতিকর সর্ব পাপনাশক এই শুভপ্রদ মহাব্রত পালণ করে না, সে জীবনের অন্তকালে নরকে গিয়ে চিরকাল সেখানে যাতনা ভোগ করে। পৃথিবীতে থাকাকালীনও সে দুর্ভাগিনী হয়।” এই মহাব্রত করলে শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণের অভয় পাদপদ্মে অচলা ও অব্যভিচারিনী ভক্তি লাভ হয়ে থাকে।
শ্রীশ্রী রাধাষ্টমী ব্রত বিধানে পারণে তথা পূর্ণ দিবসের প্রমাণঃ
ভাদ্রমাসি সিতে পক্ষে অষ্টমীর্যা তিথির ভবেৎ তস্যাং বিশাখা নক্ষত্রে দিনার্দ্ধেহ ভিজিতেক্ষনে অতীব সুকুমারাঙ্গীং কির্তিদা অসুত কন্যাকম এবংসদনুসন্ধা নৈস্তারং তিথিং সমুপোষয়ে্ৎ পরেহহ্নি পারনং কূর্যাৎ বৈষ্ণবৈ সহ বৈষ্ণব। (ভবিষ্যৎ পুরান-সুত সৌনক সংবাদ) অনুবাদঃ ভাদ্রমাসি অষ্টমীতিথীতে বিশাখা নক্ষত্র যুক্তদিনে মধ্যাহ্ন কালে কির্তীদা দেবীর গৃহে পরমা সুন্দরী শ্রীমতি রাধারানীর আবির্ভাব হয়।সেই শুভ তিথি সংযুক্ত দিবসে ব্রত ধারন করিবে এবং পরদিন প্রাতসময়ে বৈষ্ণব গন সহ বৈষ্ণব পারন করিবে।
তাহলে এবার ভাবুন, এরকম পূণ্যময়ী ব্রত কদাপি অর্ধবেলা উপবাস বলে পালন করা উচিত নয়।আপনি অর্ধবেলা উপবাস থাকলে, আপনার ব্রত পূর্ণ হবেনা এবং নরকগামী হবেন। কদাপি কোন উপবাস অর্ধদিবস বা দুপুরবেলা, ও গোধূলীবেলা বা সন্ধ্যা অবধি কোন উপবাস শাস্ত্র সমর্থন করেনা, যেকোন তিথি তা একাদশী হোক বা ভগবততত্ত্বের আবির্ভাব তিথি, ঐদিন উপবাস থেকে পরেরদিন উপবাস ভঙ্গ করতে হয়। যেমন একাদশীর উপবাস থেকে দ্বাদশীতে পারণ করতে হয় ঐরকম রাধাঅষ্টমীর উপবাস পুরো দিনরাত থেকে পরদিন নবমীতে পারণ করতে হবে যার শাস্ত্রীয় প্রমাণ উপরে দেওয়া হয়েছে। রাধে রাধে
ভারতের উত্তরাঞ্চলের অনেক রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের বৃন্দাবন এবং তার আশেপাশে রাধাষ্টমী জাঁকজমকের সাথে উদযাপিত হয়। ভক্তরা সূর্যোদয়ের আগে উঠে রাধার উপাসনা করেন। তাঁরা এমন খাবার তৈরি করেন যা রাধা দ্বারা লালিত বলে মনে করা হয়। অনেক মহিলা পঞ্চমৃতে রাধা মূর্তি গুলি নিমজ্জিত করেন যাতে দুধ, গুড়, দই, মধু এবং ঘি থাকে। শৃঙ্গার বা সৌন্দর্যায়নের জন্য তৈরি জিনিসগুলিও ধূপ এবং প্রসাদের সাথে দেবীকে দেওয়া হয়। তাঁর প্রতিমাও নতুন পোশাকের সঙ্গে ফুল দিয়ে সাজানো হয়। ভোগ হিসাবে দেওয়া প্রসাদটিও পরে দেবীর আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য ভক্তদের মধ্যে পরিবেশন করা হয়।
রাধাষ্টমী ব্রত
৪ সেপ্টেম্বর রাধাষ্টমীর ব্রত উদযাপন। তবে অষ্টমী তিথি শুরু হচ্ছে আজই, শনিবার ৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ২৮ থেকে। অষ্টমী তিথি শেষ হচ্ছে আগামী কাল ৪ সেপ্টেম্বর রবিবার সকাল ১০টা ৩৯ মিনিটে।প্রসঙ্গত, দেশজুড়ে চলছে মহালক্ষ্মীর ব্রতও। বিষ্ণুপুরাণ ও নারদপুরাণে এই ব্রতের উল্লেখ আছে। এই পুজোয় অষ্টলক্ষ্মীর কৃপালাভই আসল কথা। এই পুজোয় ও ব্রতে সেই অষ্ট লক্ষ্মীর আরাধনাই করা হয়। সব মিলিয়ে মহালক্ষ্মীব্রত ষোলো দিনের পর্ব। অষ্টমী তিথি পড়ছে ৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ২৮ মিনিটে, তিথি শেষ হচ্ছে ৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে। তবে মহালক্ষ্মী ব্রত আদতে শেষ হচ্ছে ১৭ সেপ্টেম্বরে।